পায়েল মণ্ডল
মেধা, বিষন্নতা, আত্মহত্যা
ধারণা করা হয় অত্যন্ত মেধাবীদের মাঝে কোন না কোন মানসিক অসঙ্গতি থাকে। আধুনিক গবেষণা এই ধরণার সপক্ষে বাস্তব প্রমাণ হাজির করে। ২০০৫ সালে আইওয়া ইউনিভার্সিটির সাইকোলজিস্টরা একটা গবেষণা করেন কবি সাহিত্যিকদের মাঝে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে কবি ও লেখকরা ভয়াবহ মানসিক অবসাদের শিকার। এগারোজন আমেরিকান নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত নোবেলজয়ী লেখকের মাঝে চারজন ভয়াবহ এ্যলকোহল আসক্ত ছিলেন। এই বরেণ্য চার নোবেলজয়ী লিখিয়ে হলেন ইউজিন ও নেইল, সিনক্লেয়ার লুইস, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইলিয়াম ফকনার ভয়াবহ এ্যলকোহল আসক্ত ছিলেন। এছাড়াও ভয়াবহ এ্যলকোহলিক ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আইরিশ লিখিয়ে জেমস জয়েস যিনি শতবর্ষ সেরা লিখিয়ে। ভদ্রলোক ধারকর্য করেও মদ পান করতেন। মৃত্যুর ৭৬ বছর পরে আজ তাঁর ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বিলিয়ন ডলারেরও উপরে। আজ তাঁর নামে একাধিক লিকার ব্রান্ড আরো নানাবিধ ব্যবসা।
আরেকটি গবেষণা চালান সুইডেনের ক্যারোলিন্স ইন্সটিটিউটের গবেষকেরা ১.২ মিলিয়ন রোগীর উপর। রোগীরা এ্যলকোহল, স্কেটজোফ্রেনিয়া, মানসিক অবসাদ এবং আত্মহত্যা প্রবণতায় ভুগছিল। এদের মাঝে যারা লেখালেখির সাথে জড়িত তারা প্রবল ভাবে ড্রাগ ও এ্যলকোহলে আসক্ত এবং একের অধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
কবি ও লিখিয়েরা যারা আত্মহত্যা করেছেন এমন তালিকার শীর্ষে আছেন - সিলভিয়া প্লাথ, সারা ট্রিয়াসডেল, ভার্জিনিয়া উল্ফ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এ্যন সেক্সটন, মায়াকোভস্কি, মিশিমা ইউকিও সহ শত শত কবি সাহিত্যিক।
কিছু কবিদের লেখায় তারা জানিয়ে দেন যে তারা নিজেই নিজের নীবনাবসান ঘটাবেন। সিলভিয়া প্লাথ ও এ্যান সেক্সটনের কবিতায় স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়। মনোবিজ্ঞানীরা এদের উপর গবেষণা করে এই মত দেন। বিজ্ঞানীরা আরো চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশ করেন। তারা দুই ক্যাটাগরীর কবির কবিতা গবেষণার নমুনা হিসেবে নেন। প্রথম ক্যটেগরী যাদের সাধারণ মৃত্যু হয়েছে আর অন্য ক্যাটেগরী যারা আত্মহত্যা করেছে। বিজ্ঞানীরা মোট ১৫৬টি কবিতা নেন। আমেরিকা, রাশিয়া ও ব্রিটেনের আত্মহত্যাকারী কবিদের কবিতা তাঁরা নির্বাচন করেন গবেষণার জন্য। তাঁরা দেখতে পান যে আত্মহত্যাকারী কবিদের শব্দচয়ন, ছন্দ, কবিতার ভাষা, বিষয়বস্তু সাধারণ ভাবে মৃত কদিদের থেকে সম্পুর্ণ আলাদা ধাঁচের। আত্মহত্যাকারী কবিরা খুব বেশী করে এলিয়েনেশনের ইমেজ ও আত্মকেন্দ্রিক কবিতা বেশী লেখেন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের বিজ্ঞানী প্রফেসর জেমস পেন বেকার এই গবেষণাটি পরিচালিত করেন।
আত্মহত্যাকারী কবিরা ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দ বেশী ব্যবহার করেছেন সাধারণ ভাবে মৃত কবিদের চেয়ে। প্রফেসর পেন বেকার বলেন- “আত্মহত্যাকারী কবিরা তাদের নিজেদের কথা বেশী বলেছেন। তাদের লেখায় নিজের বাহিরে অন্যরা কম প্রাধান্য পেয়েছে। আত্মহত্যাকারী কবিরা “কথা [ talk], “শেয়ার [Share]’, “শোনা Listen]’ এই শব্দগুলো অন্য কবিদের চেয়ে কম ব্যবহার করেছেন। প্রফেসর পেন বেকার লক্ষ্য করেন যে সাধারণ মৃত কবিরা তাদের বয়েস বাড়ার সাথে সাথে এই শব্দগুলোর বেশী ব্যবহার করেছেন।প্রফেসর পেন বেকার তার গবেষণা নিয়ে বলেন যে আত্মহত্যাকারী কবিদের বিশেষ শব্দগুচ্ছের বেশী ব্যবহারে এটা প্রমাণ করেনা যে অন্য কবিরা যারা এই শব্দগুলো বেশী ব্যবহার করবেন তারাও আত্মহত্যাকামী হবেন।
এই উপমহাদেশে অনেক উর্দূকবি আত্মহত্যা করে নিজেদের জীবনাবসান ঘটান। তাঁদের অধিকাংশ চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের জীবনাবসান ঘটান। এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলেন –
শামস আগা, সাকের জালালী, সারা শেগুপ্তা, আনাম মইন, সারভাত হোসেইন, কামার আব্বাস নাদিম প্রমূখ।
সামস আগা নাম করা উর্দূ ছোটগল্প ও উম্পন্যাস লিখিয়ে। জন্ম ১৯২২ সালে। ছেলেবালায় তাঁর বাবা মার ছাড়াছাড়ি হ্যে যায়। বেড়ে ওঠা নানার কাছে। বাবামায়ের ছাড়াছাড়ি ছেলেবেলায় তাঁর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তিনি হীনমন্যতায় ভুগতে শুরু করেন যা পরিণত বয়স অবধি তাড়া করে ফেরে। তিনি উর্দূ ভাষায় ছোট গল্প লেখেন। একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেন এবং তা অসমাপ্ত রেখে আত্মহননের পথে বেঁচে নেন। ঘুমের ওষুধ খেয়ে জীবনাবসান করেন।
সাকিব জালালি হলেন ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তি অন্যতম উর্দূ কবি। ১৯৩৪ সালে আলীগরের এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তাঁর মা মারা যায়। তিনি মাতৃহীন বেড়ে ওঠেন। মায়ের মৃত্যু তাঁর মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। বাবা ছিলেন মানসিক রোগী ফলে তাঁর বেড়ে ওঠার সময়টা মোটেও সুখকর ছিলো না। মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসে কবি সারগোদায় চলন্ত ট্রেনের নীচে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর কাব্য সংকলন ‘রোশনি আয়ে রোশনি’ ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশনী সংস্থা সাঙ্গে-এ- মিল তাঁর কবিতা সমগ্র ‘কুলিয়াতে এ সাকিব জালালি’ নামে ২০০৪ সালে প্রকাশ করে।
২৯৫৪ সালের ৩১’শে অক্টোবর পাকিস্থানের গুজরানওয়ালে সারা শেগুপ্তা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উর্দূ ও পাঞ্জাবী কবিতা লিখতেন। শেগুপ্তার জন্ম যদিও দরিদ্র ও অশিক্ষিত পরিবারে কিন্তু তাঁর লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। আর সেই সুবাদে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তিনি ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি। ছোটবেলায় মা মারা গেলে, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। নতুন মা তাকে মেনে নিতে পারেনি আর তাই তিনি বেড়ে ওঠেন অসম্ভব মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মাঝে। তিন তিনবার তাঁর বিয়ে হয়। আর এসব কারণে প্রচণ্ড ভাবে ভেঙ্গে পড়েন মানসিক ভাবে। ১৯৮৪ সালে জুন ৪-এ করাচীতে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
মৃ্ত্যুর পরে তাঁর দুটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় ‘আখি” ও ‘নীদ কা রঙ!’ আর এক উর্দূ কবি আসাদ আলভি তাঁর কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ভারতীয় লেখিকা বন্ধু অম্রিতা প্রীতম তাঁর জীবনী গ্রন্থ লেখেন ‘এক থি সারা’ নামে যা ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়। নাট্যকার শাহিদ আনোয়ার তাঁর জীবনের উপর একটা নাটক লেখেন ‘ম্যায় সারা’ নামে।
আলভির ইংরেজী অনুবাদের তাঁর কবিতা –
“A Mortgage of the Moon
Our tears were given eyes
we wrangled with our vivacity
and became our own bans
The hollering of stars reaches the earth before skies
I untangled death’s hair
and lengthened my lies
Sleep plays with eyes a game of marbles
The evening tholes hypocrite colors
I mortgaged a moon to the skies
I am a lantern in death’s hands
I see a death-chariot upon the wheels of birth
My human is inhumed in turfs
Lift your prostate heads
Death’s left one child in my lap!”
আনিস মইন ১৯৬০ সালে নভেম্বর ২৯-এ জন্মগ্রহণ করেন। কট্টর রক্ষণশীল পরিবারে আনিস মইন জন্মগ্রহণ করেন। সূফীবাদের প্রতি ছিল তাঁর প্রচণ্ড অনুরাগ। এক সুফী বন্ধু তাঁকে বলেন পার্থিব জীবনের পরের জীবন এতই সুখকর যে সেই জীবনের স্বাদ কেউ এই জীবনে অনুভব করলে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ আত্মহত্যা করতো। তিনি মূলত সুফী ঘরানার কবিতা লিখতেন। পেশাগত ভাবে তিনি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। কথিত আছে, তিনি তাঁর এক কলিগের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েন এবং তাঁকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু পারিবারিক চাপে তিনি তাঁর পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারেননি। পেশাগত জীবনেও নেমে আসে চরম দূর্ভোগ । তিনি যে ব্যাংকে চাকুরী করতেন সেই ব্যাংকে একটা জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। তিনি মনে করেন ব্যাংক ম্যানেজার হিসেবে এটা তাঁর দায়িত্ব ছিলো জালিয়াতিকে রোখা। সব মিলিয়ে আনিস মইন চরমতম ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন। ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৮২ সালে মুলতানে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে এই নোটটি রেখে যান-
“Zindagi se zyada azeez Ammi aur pyare abbu jaan
Khuda aapko humesha salaamt rakhe
Meri is harkat ki sivaaye iske koi aur wajah nahin ki main zindagi ki yaksaniyat se ukta gaya hoon.... kitaab-e hayat ka jo safha ulatTa hoon us par wohi tehreer nazar aati hai jo pichhle safhe pe padh chuka hota hoon... is liye maine dher saare oraq chhod kar woh tehreer padhne ka faisla kya jo aakhri safhe pe likhi hui hai.... Mujhe na toh ghar walon se shikayat hai, na daftar ya baahar walon se... balky logon ne toh mujhe itni mohabbat ki hai ki main iska mustahik bhi nahin tha. Logon ne agar mere saath koi zyaadati ki bhi hai ya kisi ne mera kuchh dena hai toh main woh muaaf karta hoon.. KHUDA meri bhi zyaadtiyon aur gunaahon ko muaaf farmaaye.. Aur aakhir mein ek khaas baat woh ye ki _________ aakhir mere paas RAAH-E -KHUDA mein dene ko kuchh bhi nahin hai... so main apni aankhen eye bank ko donate karta hoon... mere baad yeh aankhen kisi mustahiq shakhs ko laga di jaayen toh meri rooh ko haqeeqi sukun haasil ho sakne ki umeed hai. Marne ke baad mujhe aapki duaon ki pehle se zyada zaroorat rahegi.. albatta ghair'zaroori rasomat par Paisa kharch karne ki zaroorat nahin hai maine kuchh rupaiya aamna ke paas isi liye rakhva diye hain ki is mauqe pe kaam aa saken....
Aapka nalaayaq beta
Anis Moin
Aslam Khan building Multan”
সারভাত হোসেইন করাচীতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৯ সালের নভেম্বর ৯-এ। ছাত্রজীবনে তিনি তাঁর এক ক্লাসমেটের সাথে প্রেমে পড়েন যিনি পরবর্তি জীবনে পাকিস্তানের নাম করা কবি ও ফেমিনিস্ট এক্টিভিস্ট হিসেবে যথেষ্ঠ না করেন। দীর্ঘদিন বেকার থাকার পরে করাচীর এক কলেজে উর্দূভাষার লেকচারারের কাজ নেন। লারকানাতে তাঁর বদলী হয়। এখানকার নির্জনতার মাঝে তিনি আবিস্কার করেন একধরণের নিঃসঙ্গতা। এ সময়ে তাঁর কবিতা ভরে ওঠে এলিয়েনেশনের ইমেজে। তিনি ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন। ১৯৮৮ সালে হায়দ্রাবাদে বদলী হন, এসময় তাঁর মানসিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। তাঁকে মানসিক চিকিৎসা দেয়া দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে তিনি চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। কিন্তু সেবার তিনি বেঁচে যান কিন্তু তাঁর দুটি পা চিরতরে হারান। পা হারানোর পরে তিনি আরো ডিপ্রেসিভ হয়ে পড়েন। সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬ শালে আবারো চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এবার তাঁর আত্মহত্যার প্রচেষ্টা শোফোল হয়। তিনি চিরতরে মর্তলোক ছেড়ে যান।
তাঁর একটি কবিতা-
“achchhā sā koī sapnā dekho aur mujhe dekho
jaago to ā.īna dekho aur mujhe dekho
socho ye ḳhāmosh musāfir kyuuñ afsurda hai
jab bhī tum darvāza dekho aur mujhe dekho
sub.h ke ThanDe farsh pe gūñjā us kā ek suḳhan
kirnoñ kā guldasta dekho aur mujhe dekho “
এ আর এক পাকিস্তানি লিখিয়ে কামার আব্বাস নাদীম ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহন করেন। পেশায় ছিলেন চিকিৎসক ছিলেন। নাদীম মূলত ছোট গল্পকার ছিলেন। যুবা বয়স থেকে তিনি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েন। এই গল্পকার ভয়ঙ্কর ডিপ্রেশনে ভুগতেন। তাঁর গল্পে উঠে এসেছে মানব জীবনের এ্যবসার্ডিটিজ, তাঁর গল্পের চরিত্ররা নিজের আদলে বিষন্নপ্রবণ। নাদীম প্রায়শই হ্যালুসিনেটিক অবস্থায় চলে যেতেন। নিজে চিকিৎসক হলেও তাঁকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে ট্রাংকুলাইজার প্রেসক্রাইব করা হয়। একদিন অতিমাত্রায় ট্রাংকুলাইজার খেয়ে গাড়ি নিয়ে বের হন। হাইস্পিডে গাড়ি চালিয়ে সরাসরি হাইভোল্ট ইলেক্ট্রিসিটি পোলের সাথে গাড়ী ক্রাস করে নিজের জীবনাবসান ঘটান।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন